মা ~ ওসমান আলী। গল্প। ওসমান আলীর গল্প
১.
মা মারা গেলো! আষাঢ় গিয়ে শ্রাবণ মাস পড়েছে। তখন ভরপুর বর্ষা। চুলোটা উঠানে। টানা তিনদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে উঠানে হাটুজল হয়েছে। এখনো বৃষ্টির ভাবগতি তেমনই। ঘরে কোনো খাবারও নাই। রাতে ক্ষুধার্ত পেটে চোখে ঘুম আসে না। মাকে কাতরস্বরে বার বার বলি, ' মা ক্ষুধা লাগছে, খুব ক্ষুধা কিছু খাইতে দাওনা মা '। মায়ের মুখে কোনো কথা নাই। জলে পথ ঘাট সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়দিন থেকে মাতবর বাড়িতে কাজে যেতে পারেন না মা।
ঘরে পুরাতন জীর্ণ একটা চৌকি। তার উপরে ছেড়া দুইটা কাঁথা। একটা কাঁথা নিচে আরেকটা উপরে দিয়ে মা আমাকে তার বুকে শক্ত করে টেনে ধরে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। ক্ষুধার জ্বালায় আমার ঘুম আসছে না, তবুও একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম মায়ের আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ায়। আর মা রাজ্যের চিন্তা কাঁধে নিয়ে কি যেন ভাবছে।
২.
নৌকা যেমন ঘাটে ঘাটে গিয়ে থামে এবং কাজ সেরে চলে যায়। কিছু পুরুষ মানুষও ঠিক তেমন হয়। এরা বিভিন্ন যায়গায় ঘুরে আর একটা করে বিয়ে করে, প্রয়োজন শেষ হলে আবার অন্য যায়গায় গিয়ে আবার বিয়ে করে। আমার বাবাও নাকি এ দলেরই একজন ছিলো, মানুষ বলে। মানুষ বলে বলছি কারন এইসব বিষয়ে মা আমার সাথে কোনো কথা বলে না। একদিন হঠাৎ করেই তিনি এ গাঁয়ে আসেন এবং কিছুদিনের ভিতর সবার সাথে মোটামুটি পরিচয় হওয়ার পরে আমার মাকে অসহায় অনাথা পেয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করে। মা সারাদিন মাতবর বাড়িতে রান্নাবাড়া, ঝাড়া-মোছার কাজ করে যা আনে বাবা ঘরে বসে বসে তাই খায়। কাজ কাম কিছু করে না। একদিন কাজ করে ফিরে মা'র রান্নাবাড়া করতে একটু দেরি হওয়ায় বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া বাধিঁয়ে দেয়। তুমুল ঝগড়া। মায়ের গায়ে হাত পর্যন্তও তুলেছেন। মা সারাদিন কাজের ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাগে, ক্ষোভে কেঁদে কেঁদে সেদিন বাবাকেও দু-চারটে কথা শুনিয়ে দেয়, " মাইনষের সোয়ামী কত কিছু করে, কামাই-রোজগার করে, বাজার-সদাই কইরা আনে আর বউ সেগুলা রাইন্ধা একসাথে খায়। কত সুখে থাকে। আর আমার এই পোড়া কপালে সুখ কি জিনিস চিনলাম না। ছোটবেলায় মা-বাপেরে হারাইলাম। সোয়ামী একটা আছে তো খালি নামে মাত্র, কাজে কামে নাই। বাড়িত বইসা থাইকা থাইকা তেজ ওঠে, আর আমারে খালি গরম দেখায় "। সে রাতেই বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যায় আর ফিরে আসে না। এর আগেও নাকি আরো দুই যায়গায় বিয়ে করে আমার মা'র মতোন তাদেরকেও ছেড়ে চলে গিয়েছে। কাজের মধ্যে বিয়ে করাটাই নাকি তার কাজ।
৩.
মা দিনকে দিন রুগ্ন হয়ে পড়ে। মুখ শুকিয়ে যায়, চোখ জোড়া গর্তে ডুকে পড়ে, চোখের নিচে কালি পড়ে। কারো সাথে ভালোভাবে কথা বার্তা বলে না। সারাদিন ভাঙা ছোট ঘরটায় শুয়ে শুয়ে দিন কাটায়। বেঁচে থাকার সব আশা যখন হারিয়ে ফেলে তখনই আমার জন্ম হয়। বড় পুকুরে একটি পিপড়া যেমন ছট্টো একটু খর-কটা পেলে তাকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। আমাকে পেয়ে আমার মায়েরও সেই দশা হলো। বেঁচে থাকার নতুন একটা কারণ পেল। রুগ্ন ভগ্ন শরীরটায় ক্রমশ শক্তি সঞ্চার হতে শুরু করলো, যেন দীর্ঘদিন পরে আঁধার একটা ঘরে মিটমিট করে প্রদীপ শিখা জ্বলে উঠছে।
৪.
কিছুদিন পর মা আবার কাজে যাওয়া শুরু করেছে। আমিও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছি। আমাদের ছোট ঘরটায় এখন আর থাকার মতো অবস্থা নেই। ছনের চাল পুরাতন হয়ে শুকিয়ে বড় বড় ফুটো বেড় হয়েছে। সেখান দিয়ে পুরো আকাশটা দেখা যায়। ঘরের বেড়াগুলো শুকিয়ে মচমচা হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়তেছে। বর্ষার আগেই ঘর মেরামত করতে হবে। সেজন্য মা আগে থেকেই কিছু করে টাকা সঞ্চয় করে রেখেছে। কিন্তু মাঝখানে হঠাৎ করেই আমার বড় একটা অসুখ হওয়ায় চিকিৎসা করতেই সব টাকা ফুরিয়ে যায়। তাই আর ঘর মেরামত করা হলো না।
৫.
আষাঢ় মাস চলে এসেছে, চালের যেখানে যেখানে ফুটো মা তার নিচে কথাও পলিথিন, কথাও মুখ কাটা প্লাস্টিকের বোতল, কথাও ভাঙা হাড়ি রেখে দিয়েছে যাতে করে বৃষ্টির পানি সেখানটায় জমা হয়। ভাঙা বেড়াগুলোতে দড়ি দিয়ে প্লাস্টিক বেঁধে দিয়েছে যাতে বাতাসে ছিটা বৃষ্টি ঘরে প্রবেশ না করে। এভাবে আষাঢ় মাস গিয়ে শ্রাবণ মাস পড়েছে। বৃষ্টির আর বিরাম নেই। ক্ষুধা পেটে কখন যে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারি না। মাঝরাতে বৃষ্টির বেগ আরো প্রবল হলো, বাতাস তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ঝড় এসেছে। চারিদিকে কুটকুটে কালো অন্ধকার, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমকে গাছের মাথার বিরতিহীন নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। মা আমাকে বিছানা থেকে তুলে যেখানটায় বৃষ্টি কম পড়ছে সেখানে বসে আমাকে কোলে নিয়ে কাঁথা দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিয়েছে। আমি মায়ের কোলে পৃথিবীর সব ভয়কে তুচ্ছ করে নির্ভয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
৬.
সকালে বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ শান্ত হয়ে এসেছে। ক্ষুধায় পেটে টান ধরেছে। মা এখনো শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরে আছে। আমার ব্যাথা লাগছে। কোল থেকেই আমি মাকে বলছি, " মা আমার খুব, খুব ক্ষিধা লাগছে, কিছু খাইতে দেওনা। " এখনো মায়ের মুখে কোনো কথা নেই। আমি কোল থেকে নামতে যাবো তখনও মা আমায় ছাড়ছে না। আমি বলছি, " মা বাইরে যাবো হাত দুটো সরাও" মা শুনছে না। লক্ষ করলাম মায়ের মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ভিজে আছে। অথচ মায়ের কোলে কাঁথার ভিতর আমার শরীরে এক ফোঁটা পানিও নেই। এবার আমার একটু ভয় করছে। শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে মায়ের হাত দুটো ছাড়িয়ে নেমে আসতেই মা'র নিথর দেহটা ধপাস করে মাটিতে পরে গেল। আমি ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, পেটে ক্ষুধার কারনে ততটা আওয়াজ হলো না। তবুও বাড়ির পাশ দিয়ে প্রতিবেশি রমিজ চাচা যাওয়ার পথে কিছুটা শব্দ পেয়ে বাড়িতে এসে মাকে দেখে মুখখানা মলিন করে আমার দিকে চেয়ে বলে," সাগর তোর মা আর নেই, তোর মা মারা গেছে "।
আরোও পড়ুন : খারাপ বাবা। ছোটগল্প। ওসমান আলী