খারাপ বাবা। ছোটগল্প। ওসমান আলী



খারাপ বাবা


সবাই তার বাবা-মা'কে নিয়ে গর্ব করে। আমি ঠিক গর্ব বলবো না। আমি বলবো অহংকার করে। এবং বলে তার বাবা-মা পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবা-মা। কিন্তু আমার বেলা ঠিক তার বিপরীত।  আমার বাবার মত খারাপ বাবা মনে হয় দুনিয়ায় আর কারোরও নাই। আমার বাবা আমাকে একদম দেখতে পারে না। যখনি সামনা সামনি দেখা হয় কোনো না কোনো কিছু নিয়ে বাবা আমাকে বকবেই। বাবা বলতে গেলে রগচটা ধরনের লোক, অল্পতেই রেগে যায় এবং কঠিন মানুষ। তাই বাবা না ডাকলে আমি কখনই বাবার সামনে যেতাম না। আমার প্রচুর জেদ ছিলো। মা আমাকে অনেক বুঝাত আর বলত, বাবা এত জেদ ভালো না। অতিরিক্ত জেদ দুর্ঘটনা টেনে আনে। আমি মা'র কথায় একদম কান দিতাম না। আমি আমার মতই। দারিদ্রতার সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে আমাদের অবস্থান। বলতে গেলে অতি অল্প পরিসরে থাকার যায়গা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। বংশ পরম্পরায় পাওয়া কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিলো না। দিন এনে দিন খাই। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ২ কি:মি: দূরে একটি বাজার আছে। বাবা সেই বাজারে এক সারের দোকানে কাজ করতো। রোজ সকাল ৯ টায় চলে যেত এবং রাত ১১ টা সাড়ে ১১ টার সময় বাড়ি ফিরে আসত। তাই হয়ত এমন খিটখিটে স্বভাবের মেজাজ ছিল বাবার। আমার প্রায়ই অনেক মন খারাপ হতো। এবং অনেক আফসোস করে বলতাম ইস্ আমার বাবা যদি করিমের বাবার মত হত, ইস্ আমার বাবা যদি রফিকের বাবার মত হত।

একদিন বাড়ির সামনে রাস্তায় কুকুর দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। এবং আমি কুকুরকে ভেজকি দিতে গেলাম। ভেজকি দেওয়ার আগেই কুকুরটি উল্টো তেড়ে এসে আমার পায়ে দিলো এক কামড় বসিয়ে। আমার সেকি চেঁচাড়ি আর কান্না। আওয়াজ শুনে কয়েকজন লোক ছুটে এল এবং কুকুরটিকে তাড়া করে দূরে রেখে এলো। তারপর মা সহ বাড়িতে এলাম। মা আমাকে বাড়িতে রেখে পাশের বাড়ির চাচার কাছে গিয়েছে বাবাকে ফোন করে বলার জন্য। বাড়ি থেকেই মার ফোনে বলা কথা শুনা যাচ্ছে, 'কই আফনে?  বাড়িতে একটু আহেন ত রাজুরে কুকুরে কামড়াইছে। '
কুকুরের কামড়ের ব্যাথার চেয়ে আমার বেশি ভয় হচ্ছিলো বাবাকে নিয়ে। আগেই বলেছিলাম আমার বাবার মত খারাপ বাবা আর কারোরও নাই। বাবা যদি এসে দেখে আমার এই অবস্থা তাহলে আর আমার রক্ষা নাই।
যা ভয় করেছিলাম তাই। কার যেন একটা সাইকেল নিয়ে বাবা বাড়িতে চলে এসেছে। এসেই ঘামা শরীর নিয়ে আগে আমার কাছে আসল কামড়ের স্থান দেখে আমাকে জিগ্যেস করে সবকিছু শুনলো।
ভাবছেন সবকিছু ত ঠিকই আছে তাহলে আমার বাবা খারাপ কিভাবে হলো। তারপর কি হলো শুনুন, বাবা সবকিছু শুনার পর আশেপাশে কি যেন খুঁজতেছিল। আমি বুঝতে পারলাম যে বাবা লাঠি খুঁজতেছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে আমি সেখান থেকে দিলাম এক দৌড়।
প্রায় দেড় ঘন্টা পর মা আমাকে খুঁজে নিয়ে আসল। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আমি বললাম ডাক্তারের কাছে কেন? । মা বললেন, কুকুর কামড়ালে নাকি কিসের বলে ইনজেকশন দিতে হয় কয়টা। আমি তৈরি হয়ে ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে গেলাম। গিয়ে বাবার সাইকেলের পিছনে উঠে বসলাম। বাবা আমাকে নিয়ে বাজারে গেলো। যে দোকানে বাবা কাজ করে সে দোকানের বাইরে আমাকে বসিয়ে রেখে বাবা ভিতরে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে ভিতর থেকে কিসের যেন একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আসতেছিল। আমি ভালোভাবে বোঝার জন্য একটু ভিতরে যেতেই যা দেখি তার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। দেখি বাবা ম্যানেজারের হাত ধরে অসহায়ের মত কাকুতি-মিনুতি করে কিছু টাকা চাচ্ছিলো। বাবার কাছে কোনো টাকা ছিলনা। কিন্তু ম্যানেজার বাবাকে টাকা না দিয়ে বারবার ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে এবং বাজে গালিগালাজ করতেছে।
মূহুর্তেই আমার পূর্বের সব ভ্রান্ত ধারণা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে বাবা এক বেলা খেতে না পারলে অন্যের কাছে হাত পাতেনি। আজ আমার জন্য সে বাবা অন্যের কাছে এতটা ছোট হচ্ছে। নিজের প্রতি নিজের খুব ক্ষোভ হচ্ছিলো। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছিলো।
বাবা অনেক চেষ্টা করার পরও শেষমেষ নিরাশ হয়ে মন খারাপ করে ফিরে আসছিলো। বাবাকে খুব অসহায়  মনে হচ্ছিলো। বাবাকে এরকম আগে কখনও দেখিনি। আমার বুক ফেটে কান্না আসতেছিল।
পিছন থেকে বাবার এক বন্ধু বাবাকে ডাক দিয়ে থামিয়ে বাবার কাছে আসলো। তাড়া একসাথেই কাজ করে। সেও গরীব। কোনো কারণে তার গতকালকের টাকাটা খরচ করতে হয়নি এবং আগের আরো সামান্য কিছু টাকা ছিলো সেগুলো বাবাকে দিচ্ছিলো। বাবা কয়েকবার না নিতে চাওয়া সত্ত্বেও আর কোনো উপায় নাই দেখে নিতে হলো।

আজ সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ আমি। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। সময়ের সাথে বাবা-মা ও ইহকাল ত্যাগ করেছেন। তবুও এই স্মৃতি টুকু আমাকে এখনো তাড়না করে। আজ একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার পুরো পৃথিবী জুড়েই বাবার অনুপস্থিতি অনুভব করি। এখন আমিও অহংকার করে বলি আমার বাবা-মা পৃথিবীরর শ্রেষ্ট বাবা-মা। তারা না থাকলে আজ আমার এই অবস্থানে থাকা সম্ভম হত না। বাবা-মা আমি তোমাদের খুব মিস করি। খুব খুব মিস করি।

- কই কি হলো তোমার, এইজে তোমার কফি নেও। প্রত্যেক ছুটির দিন বসে বসে কি যে এত ভাব তুমি। বুঝি না। আমি একটু মুচকি হেসে বউয়ের হাত থেকে কফিটা নিলাম।

এটা হয়তো শুধু নিছক একটি গল্প। কিন্তু বাস্তব জিবনে জিবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়া এক অপরাজিত বীরের নাম বাবা। বাবা মানে সাহস। বাবা মানে লড়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। বাবার তুলনা শুধুই বাবা
একজন মায়ের মত একজন বাবা সন্তানদের প্রতি তার ভালোবাসার অনুভূতিটা ব্যক্ত করতে পারে না। কিন্তু পরিবারের প্রতি অজস্র অব্যাক্ত ভালোবাসা নিয়ে ঘুম থেকে উঠে ঠিকই বেড়িয়ে পরে জিবন পরিচালনার তাগিদে। এমন অজস্র ঘটনা ঘটে বাইরে যার জন্য তাকে ছোট হতে হয়,হেয় হতে হয়, লাঞ্চিত হতে হয়। কিন্তু দিন শেষে একটি বাবা তার সমস্ত ক্লান্তি ও বিষাদ দূরে রেখে হাসি মুখে ঘরে প্রবেশ করে।

পৃথিবীর এমন সকল বাবার প্রতি আমার অজস্র শ্রদ্ধা ও সালাম।

~ ওসমান আলী।

Post a Comment

0 Comments