নিঃষঙ্গ নক্ষত্র - সাদাত হোসাইন। সাদাত হোসাইনের উপন্যাস রিভিউ




বই নাম : নিঃসঙ্গ নক্ষত্র
লেখক : সাদাত হোসাইন
প্রকাশনী: ভাষাচিত্র
মুদ্রিত মূল্য: ৪৭০ টাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৭০

নিঃষঙ্গ নক্ষত্র - সাদাত হোসাইন 


শুরুতেই বলে নিচ্ছি, নিঃষঙ্গ নক্ষত্র উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা। উপন্যাসের একদম শেষের দিকে দেখা গেছে দুজন মানুষের একান্ত কথোপকথন। সেখানে বলা হয়েছে,

-'নক্ষত্ররা নিঃসঙ্গ হবে কেন?ওরা তো সংখ্যায় অসীম!'

-'কিন্তু ওই নক্ষত্রগুলো আসলেই ভীষণ নিঃসঙ্গ। '

-'কীভাবে?'

-'আমরা এতো দূর থেকে দেখি তো, তাই বুঝতে পারিনা। ওই একেকটা নক্ষত্রে মাঝে যে কি অসীম দূরত্ব,আমরা কল্পনাও করতে পারিনা। অনেকটা মানুষের মতোই। আমরা একে অন্যের থেকে এতো দূরে থাকি যে পরস্পরের নিঃসঙ্গতা বুঝতে পারি না।'

মনে হচ্ছে,এই কথাগুলোর মাঝেই রয়ে গেছে এই উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা।

পুরো উপন্যাসের মূলকাহিনী আবর্তিত হয়েছে মূলত "অনু" নামের এক নারীকে নিয়ে। সংসারের মধ্যে থেকেও সে ছিল সংগ্রামী এক নারী। যে নারী জীবনের সেই প্রথমবেলা থেকেই দায়িত্ব নিয়েছেন পরিবারের, কর্মক্ষেত্রেও নানা চড়াই-উৎরাই পার করেছেন প্রবল সাহসিকতায়, পরম নিষ্ঠায় এবং জীবনের কঠিনতম মুহুর্তগুলোতেও থেকেছেন খুব ধৈর্য্যশীল। সেইদিক থেকে ভাবলে, লেখককে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে এমন শক্তিশালী একটি নারী চরিত্র নির্মাণ করার জন্য।

এই উপন্যাসটা ভালো লাগার আরও একটি বিশেষ কারণ হলো, এর ভাষার ব্যবহার অতি প্রাঞ্জল আর সরল। দারুণ শব্দশৈলী আর শব্দচয়ন পাঠককে আকৃষ্ট করে রাখার দুর্দমনীয় শক্তি রাখে। কঠিন বাড়তি শব্দের প্রয়োগ একেবারেই নেই।

বরং গল্পটির ছন্দ এগিয়ে গেছে এক নান্দনিক অনন্যতায়। এই উপন্যাসের মোট পৃষ্ঠা ২৭০।আমার কাছে মনে হয়েছে, এই বই পড়তে গিয়ে পাঠককে মোটেও ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবেনা।বরং এই বই পাঠককে জড়িয়ে রাখবে এক সম্মোহনী আকর্ষণের দ্বারা,আর এটাই লেখকের আসল স্বার্থকতা।
উপন্যাসের কথোপকথন যেকোন পাঠকের হৃদয়ে একটা জায়গা করে নিতে বাধ্য। লেখক এতো সুন্দর করে সংলাপগুলো বানিয়েছেন, যেন মনে হয় আরে এগুলো তো আমার মনের কথাই।কেন জানি মনে হচ্ছে, লেখক পাঠকের সঠিক অনুভূতির জায়গাগুলো স্পর্শ করতে সক্ষম। তা না হলে এমন নান্দনিক আর মুগ্ধকর সংলাপ কি করে তৈরী করেন ভেবেই অবাক হই। পাশাপাশি এটাও বুঝতে পারি, লেখক তাঁর লেখার মাঝে তাঁর সুন্দর মনের পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের পরতে পরতে তিনি শুধু মায়ার কথাই বলেন।গোপন, গভীর আর রহস্যময় এক মায়া-যে মায়ার দ্বারা টিকে থাকে জগতের প্রতিটি সম্পর্ক।

নিঃসঙ্গ নক্ষত্র উপন্যাসটিকে কি ধরনের উপন্যাস বলা যায়?


প্রথমে এটাকে আমি সামাজিক উপন্যাস ভেবেছিলাম। কিন্তু মাঝে এসে দেখলাম এটাতে রাজনৈতিক ঘটনা আশ্রয় নিয়েছে, আবার শেষের দিকে এসে থ্রিলার বা ক্রাইম রিলেটেড ঘটনার আবির্ভাব দেখতে পেলাম। তবে শেষপর্যন্ত মনে হয়েছে এটা হয়তো উপন্যাসের এক সংমিশ্রিত রুপ।

চরিত্র চিত্রায়ণে লেখক তাঁর জাদুকরী হাতের সুনিপুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন পরম যত্নে। অয়নকে বেশী ভালো লেগেছে আমার কাছে। তেমনি আলতাফ সাহেবের মতো একটি বিশেষ চরিত্রায়ণের মাধ্যমে তিনি বাস্তব জীবনের হাজারো আলতাফ সাহেবের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন।  যারা অফিসে বসের ভূমিকায় কাজ করলেও এদের এই ভদ্র চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে কুৎসিত এক মানব চরিত্র। যারা আজও নারীকে একজন মানুষ না ভেবে তাদের শুধু নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে চলেন।

নুহা,সালমা বেগম,তনু,বেণু,শামীমও উপন্যাসের জায়গায় জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।প্রতিটি চরিত্ররই নিজ নিজ জায়গা থেকে তাদের করণীয় ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি,পুলিশের চরিত্রে যিনি ছিলেন অর্থাৎ ফোরকান সাহেবের চরিত্রটিও অনন্যসাধারণ। পুলিশি দায়িত্বের বাইরেও দেখা গেছে যে,তাঁর একটা সহানুভূতিশীল মন আছে; সেখানেও রয়েছে গভীর মায়া আর মমত্ববোধ। তবে, ওয়াসিম আর জায়েদের মতো কিছু চরিত্র আছে যারা আমাদের সমাজেও আছে, যাদের পেছনে রয়েছে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির হাত। যাদের প্রশ্রয়ে কখনো কখনো তারা হয়ে উঠে বিধ্বংসী কিংবা অপ্রতিরোধ্য কোন অশুভ শক্তি।

শুরুতেই বলেছিলাম, নিঃষঙ্গ নক্ষত্র উপন্যাসের মূল চরিত্র অনু নামের এক নারীকে নিয়ে।সংসারের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, ছোট ভাই আর মায়ের মৃত্যু, ছোট বোন আর তাঁর স্বামীকে তাদের নিজের বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কর্মজীবী মহিলাদের হোস্তেলে উঠা,পুরনো চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে বহু কষ্টে নতুন চাকরি জোগার করা,নানাপ্রকার আইনি ঝামেলায় জড়ানোর মধ্যে দিয়ে যখন খুব অস্থির, নিঃসঙ্গ জীবন পার করছিল,যখন যাপিত জীবনে ক্লান্তিবোধ এসে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছিল তখন হঠাৎ তাঁর জীবনে এলো হাসান নামের এক ছেলে।যদিও হাসান অনুর অনেকদিনের পরিচিত তবুও অনুর কাছে হাসান প্রিয় হয়ে উঠে

কারণ, যেই পৃথিবীতে অনু প্রতিনিয়ত তিক্ত বিছরি অভিজ্ঞতার শিকার হয়ে আসছে, সেই একই পৃথিবীতে যে হাসানের মতো মানুষও আছে সেটা সে জানতে পেরেছে অনেক অনেক পরে।
অনু মনে মনে যে স্বপ্ন দেখতো, একটা নিজস্ব ঘর, দুইটা বালিশ, নিজের একটা মানুষ --হাসানকে দেখে তাঁর মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা সেই স্বপ্নটি আবার জেগে উঠল। হাসানের মতো ছেলেও আমাদের সমাজে খুব খুব খুব দরকার, যারা নারীকে আপন করে নিতে পারবে একান্ত ভালবাসায় আর পরম মায়ায়।

তবে উপন্যাসের শেষ পরিণতি দেখে লেখকের উপর খুব রাগ হয়েছিল প্রথমে।এমনকি,এই উপন্যাসটি পড়ার আগে আমি কিছু মানুষকে বলতে শুনেছি এটা "লেখকের সীমাবদ্ধতা "।উপন্যাসের সমাপ্তিটা ট্র‍্যাজেডিই ছিল বটে।কিন্তু সাথে এটাও মনে হলো যে,এইরকম একটা উপন্যাসের এমন একটি সুন্দর সমাপ্তিই দরকার ছিল।উপন্যাসের সুন্দর মান রাখার জন্য এই সমাপ্তিটা জুঁতসুই ছিল মনে হচ্ছে।সেদিক থেকে লেখকের সমালোচনা না করে বরং সাধুবাদ জানানো জানানো যায়।তবে আফসোস হয় হাসানের জন্য।সুন্দর ও চমৎকার গল্পের স্বার্থে অনেক চরিত্রের মৃত্যু হলেও হাসানের পরিণতি কি হয়েছিল তা জানতে পারেনি।যদিও পুরো উপন্যাসে "হাসান" চরিত্রটির উপস্থিতি অনেক কম গেছে,শেষের দিকে এসে এই চরিত্রটি হয়ে উঠেছে উপন্যাসের প্রাণ। পুরো উপন্যাসে,ওয়াসিম,আজম,জায়েদের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও হাসান চরিত্রটি ছিল একেবারেই সরস,সংযমী,প্রাণোচ্ছল আর দায়িত্ববান।
পাঠক হিসেবে আমি একটু অন্যরকম।সব বই পড়িনা,পড়তে ভালোও লাগেনা।বই পড়ি বেছে বেছে।রিকোমন্ডেশন বা বেস্টসেলার বইগুলোই পড়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।আর বইয়ের সংখ্যার চেয়ে এর গুণগত মানকে প্রাধান্য দেই বেশি, অর্থাৎ Quality, not Quantity. সেদিক বিবেচনায়,"নিঃসঙ্গ নক্ষত্র" পড়ে এটিকে একটি কোয়ালিটি সস্পন্ন বই ই মনে হয়েছে।বই পড়ে সময়ের অপচয় হয়েছে,এমনটা মনেই হয়নি।

লেখকের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি উপন্যাসটিকে সার্বিকভাবে সার্থক করে তোলার জন্য। পাঠকের মন জয় করবার মতো উপন্যাসের এক অনন্যসাধারণ প্লট সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন।সবমিলিয়ে "নিঃসঙ্গ নক্ষত্র" এক দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় উপন্যাস;এর সুন্দর প্রচ্ছদ যেমন দর্শকের নজর কাড়ে তেমনি উপন্যাসের পটভূমি পাঠকের মন কাড়ে।যেন পড়া শেষ হয়ে যায় কিন্তু তাঁর রেশটুকু দর্শককে রেখে দেয় প্রবল এক ঘোরলাগায়।

রিভিউ লিখেছেন  : সাদিকা সুলতানা লিনা

রিভিউটি বইপোকাদের আড্ডখানা  নামক ফেসবুকের এক গ্রুপ হতে সংগৃহীত

Post a Comment

0 Comments