মেঘেদের দিন - সাদাত হোসাইন
বই : মেঘেদের দিন
লেখক : সাদাত হোসাইন
প্রকাশনায় : অন্যপ্রকাশ
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
পৃষ্টা সংখ্যা : ৯৬
মুদ্রিত মূল্য : ২২৫ টাকা
সাদাত হোসাইনের উপন্যাস মেঘেদের দিন পাঠ করে এক পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন....
ঝমঝম বর্ষার দিনে কৈশোরকে হাতছানি দিয়ে স্বাগত জানানো নীলতলি গ্রামের বুড়ি নামে এক দুরন্তপনা মেয়ের হাঁসের ছানা খুঁজতে গিয়ে পিতৃতুল্য হারু ব্যাপারী নামে এক জঘন্য মানুষের লালসার শিকারে পরিণত হওয়ার মুহুর্তে এক শহুরে দম্পত্তি মারুফ ও তানিয়ার পরোক্ষ সহযোগিতায় নবজীবনের দৃশ্যায়ন দিয়ে জীবনঘনিষ্ঠ এই গল্পের সুচনা পর্বের জন্ম।
দাম্পত্য জীবনের ছ'মাস উনিশ দিন পেরিয়ে গেলেও হানিমুন করা হয়নি এই মারুফ ও তানিয়া দম্পত্তির। থাইল্যান্ডের পাতায় থেকে শুরু করে নেদারল্যান্ডসের অামস্টারডাম, ভারতের কাশ্মীর থেকে শুরু করে সমুদ্রমগ্ন মালদ্বীপ যাবার পরিকল্পনা করেও যাওয়া হয়নি মারুফের চাকুরীর কারণে। তাই অবশেষে মারুফের নানা বাড়ি নীলতলি গ্রামেই বেড়াতে আসা।
কিন্তু নীলতলি গ্রামে পা রেখেই বড় ধরণের হোঁচট খায় এই দম্পত্তি। নীলতলি গ্রামে প্রবেশ মুখেই চোখে পড়া বুড়ির সাথে হারু ব্যাপারীর অসভ্যতা আর কৈশোরের স্মৃতি বিজরিত নানা বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষের আচার আচরণ দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ করে তাদের। গ্রামের সেই চিরচেনা পরিবেশ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাড়ির উত্তর দিকে পুকুর পাড়ে নেই শৈশবের স্মৃতি বিজরিত সেই হিজল গাছ। নেই ঝুম বৃষ্টির দিনে রিনিঝিনি শব্দে বিভোর হওয়া টিনের সেই দোতলা ঘর। গ্রামের মানুষজনের মধ্যেও নেই আগের মতো সরলতা। মামা আলাল আর দুলালের আচরণেও রয়েছে যথেষ্ট আরষ্টতা। উল্টো তাদের চাহনীতে ফুটে উঠেছে কেমন যেন নিষ্টুরতা!
নীলতলি গ্রামে মাত্র দু'দিনের সফরেই এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় মারুফ-তানিয়াকে। বুড়ির বাবা হানিফ করাতি, ধূর্ত হারু ব্যাপারী আর মারুফের সৎ মামা আলাল-দুলালের নিষ্ঠুর পরিকল্পনা ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় মারুফ-তারিয়ার আনন্দঘন মুহুর্তগুলোকে। স্ত্রী শাফিয়ার প্রতি হানিফ করাতির নিষ্টুরতা যেকোনো মানব হৃদয়কে বিপর্যস্ত করে দেয়ার মতো ছিল। ছোট্ট বুড়ির প্রতি হারু ব্যাপারীর লোলুপ দৃষ্টি যেন পুরুষ শাসিত সমাজের আরেক অভিন্ন চিত্র।
ক্ষয়ে যাওয়া পুরুষ শাসিত সমাজের এক বিবর্তন কাঠামোকে লেখক এখানে খুবই চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বোঝানো হয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বৈপরীত্যের অনুভবের ধরণকে।
এ উপন্যাসে জীবনের জটিলতা, রহস্যঘেরা মানুষের অমানবিকতা, নারীর প্রতি পুরুষের বৈষম্যমূলক আচরণ ফুটিয়ে তুলতে লেখক দেখিয়েছেন এক অভিনব মুন্সিয়ানা। কোথায় যেন একটা ক্ষত, একটা অসম বিন্দু প্রতিনিয়ত অপরাধবোধের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে অবিরত।
মেঘেদের দিন জীবনঘনিষ্ঠ এক উপন্যাস। প্রবহমান সময় ও সমাজ-অন্তর্গত জীবনের রূপকল্প। কাঠামোতে চেতনাপ্রবাহ কল্পনা ও স্বপ্নকে আশ্রয় করে কখনও গল্পের মেজাজে, কখনও কিছুটা ব্যক্তিগত প্রবন্ধের আঙ্গিকে, কিছুটা হয়তো বা জীবনধর্মী কবিতার ছেঁড়া ছেঁড়া আকুতি মিশিয়ে এগিয়ে গেছে গল্পের দৃশ্যপটগুলো। তবুও এর অন্তঃপ্রকৃতি, এর সমগ্র অবয়বে কিছু মানুষের হৃদয় যে বিপন্নতায় কাতর, মানুষের অন্তর্গত চেতনায় যে রয়েছে শোধন আর বঞ্চনার হাহাকার তা-ই তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে।
মানুষের জীবন বড় বেশি বিচিত্র ও কঠিন। মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের শৈল্পিক কাঠামোর মধ্যে আছে অন্যরকম অনুভূতি। সেই অনুভূতি জাগ্রত হয় সময়ের কঠিন বাষ্পে। হানিফ করাতি ছিল এর উকৃষ্ট উদাহরণ। ঘোরের মধ্যে জীবন কাটিয়ে দেয়া মদ্যপ হানিফ করাতি স্ত্রী শাফিয়াকে হারিয়ে যখন জানতে পারে তার ছোট্ট মেয়ে বুড়ির উপর হারু ব্যাপারীর লোলুপ দৃষ্টির কথা, পিতা হিসেবে সেটা মেনে নিতে পারেনি মদ্যপ হানিফ করাতিও।
হারু ব্যাপারী রক্তলোলুপ চোখের নেশার আগুনে সে নিজেই এক সময় দগ্ধ হয় সুন্দর দৃশ্যপট রচনার মধ্য দিয়ে। 'পাপের ফল সবাইকেই ভোগ করতে হবে' লেখক মূলত এ বার্তাটিই দেয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস 'মেঘেদের দিন'র মাধ্যমে।
হারু ব্যাপারী আর হানিফ করাতির অন্তিম চরিত্রায়ন আমাকে মুগ্ধ করেছে। কষ্ট পেয়েছি ছোট্ট বুড়ির কথা ভেবে। শাফিয়ার শেষ বিদায়টা আমাকে ভীষণভাবে আঘাত করেছে। মামা আলাল-দুলালের প্রায়শ্চিত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারায় আরেকটা ধুকধুকানি ছিল মনের মধ্যে।
মোটকথা সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার এই অভিনব প্রয়াসে সত্যিই আমি বিমুগ্ধ, বিমোহিত। দৃশ্যপটগুলোর চিত্রায়নে লেখক অভিনবত্বের পরশ মাখিয়েছেন। ভুল বানান ছিল যৎসামান্য। তবে কিছু অসঙ্গতি আমাকে বেশ পীড়া দিয়েছে। বুড়ির মা শাফিয়াকে শেষ কিছু দৃশ্যে শেফালী নামে উপস্থাপন করা হয়েছে। শব্দের গাঁথুনিতে মাঝে মধ্যেই পেয়েছি বেশ অপরিপক্কতা। যা লেখক সাদাত হোসাইনের লেখার সাথে যায় না। আরেকটু সময় দিলে লেখক নিশ্চয়ই এগুলোর সুন্দর সমাধান দিতে পারতেন। আর বাঁধাই, প্রিন্টিং এবং কাগজের মান ছিল খুবই উন্নতমানের। ফয়েল করা সোনালী রঙের নামলিপিতে প্রচ্ছদটা ছিল মন কেড়ে নেয়ার মতো। প্রিয় পাঠক, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান বৈষম্যমূলক দৃশ্যগুলো পুনঃ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাইলে নিঃসংকোচে হাতে তুলে নিতে পারের সাদাত হোসাইনের লেখা জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস 'মেঘেদের দিন'। আমার বিশ্বাস, বইটি পড়ে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে 'এতো দেখছি আমারই গল্প, চোখের সামনে ঘটতে থাকা এই সমাজেরই গল্প'।
রিভিউ লিখেছেন: হারুন অর রশিদ
রিভিউটি লেখকের ফেসবুক ওয়াল হতে সংগৃহীত
আমরা এই রিভিউটি পাঠকের সুবিতার্থে ব্যবহার করেছি।