স্মৃতির টানে


স্মৃতির টানে


মা চলোনা আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এখানে আমার একদম ভালো লাগে না। এই ছোট ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। চরিদিকে বড় উচু উচু অট্টালিকার ভিড়ে খোলা আকাশ দেখা যায় না। হৃদয় মুগ্ধ করা সেই মুক্ত শীতল বাতাস পাওয়া যায় না। পাখ-পাখালির ডাক শুনা যায় না। এখানে কোনো খোলা মাঠ নেই খেলার জন্য। এখানকার মানুষ গুলোও যেন কেমন, কারো সাথে মিশে না। সবাই ব্যস্ত। চলোনা মা আমরা আমাদের গ্রামেই ফিরে যাই।

রাজুর মা রেগে মেগে,এই যে আবার শুরু হলো কলের গান । তোর যন্ত্রনায় আর বাঁচি না। সারাদিন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে রাতে বাসায় আসলে শুরু হয় তোর এক পেচাল। গ্রামে যাবো, গ্রামে যাবো।গ্রামে গিয়ে কি করবি? গ্রামে আমাদের জায়গা-জমি আছে না ঘর-বাড়ি আছে?  ওখানে গিয়ে খাবি কি?

তোর বাবা তো আগেই ওপারে চলে গিয়ে বেঁচে গেছে। আর আমাকে রেখে গেছে দুনিয়ার সব ঝামেলায়। আমার মরণ হয় না কেন,মরলেই বাঁচি। এই কথা বলে  সারাদিনের ক্লান্ত শরীর তাই কাপড় নিয়ে টিওবওয়েলে গেলো গোসল করতে। রাজুর 'মা' মরার কথা বললে রাজু আর সেদিন গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা বলেনা। সে মৃত্যুকে খুব ভয় পায়। তার বয়স যখন সাঁত বছর। তখন তার বাবা হঠাৎ একদিন রাতে হার্ড অ্যাটাক করে মারা যান। মারা যাওয়ার পর শুনা যায় মৃত্যুর আগে তিনি অনেক টাকা ঋণ করেছেন। হয়তো সেই টাকার চিন্তাতেই তার হার্ড অ্যাটাক হয়। সেই টাকা পরিশোধ করার মতো আর্থিক অবস্থা তাদের ছিলো না। তাই জায়গা-জমি যেটুকু ছিলো তা বিক্রি করে যা টাকা পায় তা পাওনাদারদের বুঝিয়ে দিয়ে রাজুকে নিয়ে তার মা ঢাকায় চলে আসে।

গ্রামের আঁকা-বাকা মেঠো পথ দিয়ে রাজুর বেড়ে উঠা। সারাদিন যেখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করা। খেলাধুলা করা। এভাবেই দিন কাটাতো রাজুর। সে আজ বাস্তবতার স্বীকার হয়ে শহরের নোংরা এক বস্তিতে ছোট একটি ঘরে মুখ গোমরা করে সারাদিন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে ।
তাছাড়া রাজু গ্রামের বাড়ি যেতে চাওয়ার আর একটি বিশেষ কারণ আছে। সেটি হচ্ছে সাজু। সাজু তার গ্রামের বন্ধু। তাদের বাড়ি পাশাপাশিই ছিলো। তারা দিনের অধিকাংশ সময় একত্রেই কাটায়। আর গ্রাম শুদ্ধ দুষ্টমি করে বেরায়। পুকুরে হাস খেলা থেকে শুরু করে মাঠে দৌড় খেলা সব তারা একসাথে খেলতো। তাদের দুজনেরই পাখির বাচ্চা পোশার একটা অন্যরকম ঝোক ছিলো।

একদিন বড় একটা বট গাছে টিয়ে পাখির বাচ্চা দেখে দুজনেই তাড়াহুড়ো করে গাছে উঠতে শুরু করে। কিন্ত কিছুদূর উপরে উঠার পর সাজু আচমকা গাছ থেকে পা পিচলে পড়ে যায়। রাজুও সেই ভয়ে গাছ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে আসে। হাতে ও পায়ে বেশি ব্যাথা পায়। সেরে উঠতে বেশ কয়েক দিন সময় লেগে যায়।

তারপর একদিন ভোরদুপুরে প্রখর রোদে সাজুকে ডাকতে যায় রাজু। গ্রামে স্কুলের মাঠে পারার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে যাবে। পাশের ঘর থেকে সাজুর মা একথা শুনে। গর্জন দিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরুতেই রাজুর সেকি দৌড়। চোখের পলকেই রাজু অদৃশ্য হয়ে যায়। একথা মনে হলেই রাজুর হাসি পায়। তাই আজও শব্দবিহীন একটু হাসলো। আবার পরক্ষণেই মুখটা আগের মতো গম্ভির করে বসে রইলো।

এতক্ষণে রাজুর মা'র গোসল শেষ। গোসল সেরে রাজুর মা ঘরে প্রবেশ করলো। ঘরে প্রবেশ করেই ছেলের অমন মলিন মায়ামাখা গম্ভির মুখ দেখে ধীরে ধীরে তার মা তার কাছে গিয়ে বসলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে তার মা নিঃশব্দে শুধু কেঁদে গেলো। প্রায়ই তিনি এভাবে কাঁদেন। জানিনা কি রহস্য আছে এ কান্নায়....!

~ ওসমান আলী।

Post a Comment

0 Comments