সু্রভি ~ ওসমান আলী। গল্প: সুরভি। ওসমান আলীর গল্প
সুরভি
সজীব আর আমি ছোটবেলা থেকে একসাথেই পড়াশোনা করেছি। বন্ধুত্বের ক্ষাতিরে তার বাড়িতে আমার নিয়মিত যাওয়া হত, সেও আসত। পড়াশোনা শেষ করে আমি গ্রামের বাজারে একটা ডেকোরেশনের দোকান দিয়েছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়ি আমরা সাজিয়ে থাকি।
সজীবের ছোট বোন সুরভির বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়েতে ডেকোরেশনের সম্পুর্ণ দায়িত্বভার অর্পিত হয়েছে আমার উপরে। চাচা (সজীবের বাবা) ভীষণ রাগী মানুষ। তার কথায় বিয়ের সাত দিন আগেই প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে তাদের বাসায় হাজির হয়েছি। চাচা বলেছেন বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। সজীব আমার থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলো। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলাম। একেবারে রাতে কাজের মেয়ে লিলির কণ্ঠস্বরে ঘুম ভাঙ্গলো। সে বলল, ' আফনেরে খাইতে ডাকলো।' আমি হাত-মুখ ধুয়ে পুরোনো অভ্যাস মতো সবার সাথে একই ঘরে খেতে গেলাম। শীতের রাত, পাকা মেঝের উপর ছালা বিছানো। ছালার উপর বসেছি আমি, সজীব, চাচা ও সুরভি। চাচি আর লিলি আমাদের খাবার পরিবেশন করছেন। সুরভির বিয়ে নিয়ে পরিবারের সবাই খুশী। হাসি হাসি ভাব নিয়ে কথা বলে একে অন্যের সাথে। খুশী হবেই বা না কেনো। ছেলে সুদর্শন, বিদেশে থাকে, মাস শেষে মোটা অঙ্কের মাইনে পায়। তাছাড়া বিয়ের পর সুরভিকেও সেখানে নিয়ে যাবে শুনেছি। এ বংশে সুরভিই প্রথম মেয়ে যে কিনা বিদেশের মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি খুশী হওয়ার কথা তারই, কারণ সে রাজ্য সহ রাজকুমার পেতে যাচ্ছে। কিন্তু তার মাঝে খুশীর এমন কোনো ভাব দেখছি না। সে নীরবে মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। কোনো দিকে দেখছে না, কোনো কথাও বলছে না। অন্যদিন হলে অনেক কথা বলত। তরকারিতে বেহিসেবি ভুল ধরত,' আজ তরকারিতে লবণ বেশি হয়েছে, এত ঝাল কেনো, ভাঝি মুখে না দিয়েই বলত এটা কোনো ভাঝি হলো।' খেতে বসে এমন কত শত কথা বলত সুরভি। চাচি মাঝে মধ্যে রেগে গিয়ে বলত, এত বুঝিস তো নিজে রান্না করে খেলেই হয়।' শেষ যেদিন এ বাড়িতে আসি সেদিন খাবার সময় সুরভি হেসে হেসে বললো,'আজ কলেজে কি হয়েছে জানো মা?' মা বললো,'কি হয়েছে?' সুরভি বললো," আমার এক বান্ধবী নাম রিক্তা। সে সব সময় সবার সাথে মজা করে। সেদিন মুমিন স্যার ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছিলো রিক্তা দাড়িয়ে বললো,'স্যার আমার একটা প্রশ্ন আছে?' স্যার বললো,'কি প্রশ্ন বলো' রিক্তা বললো,'আই ডোন্ট নো এর অর্থ কি?' স্যার বললো,'আমি জানি না।' রিক্তা বলল,'আপনি স্যার তাও জানেন না!' রিক্তার কথায় স্যার চিন্তায় পড়ে গেলো, হয়ত মনে মনে ভাবছিল একি মুসকিলে পড়লামরে বাবা।" একথা বলেই সুরভি হেসে গলে যাচ্ছিলো। তার হাসির সাথে আমরাও সবাই যোগ দিলাম হা-হা-হা-হা।
অথচ সেদিনের সেই চঞ্চল মেয়েটা আজ কত শান্ত, নিশ্চুপ। তার এই নিরবতা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। আচ্ছা সেকি এ বিয়ে নিয়ে খুশী নয়? খুশী না হওয়ার কোনো কারণ আমার মাথায় আসছিল না।
২.
তারপর চারদিন গত হয়ে গেলো। সুরভির সাথে কোনো কথা হয়নি। আমি কর্মচারিদের সাথে কাজের তদারকি করছিলাম। কথায় মেহমানদের বসতে দেওয়া হবে, জামাইকে বসানো হবে কথায় এসবের। এর মধ্যে সজীব এসে বললো,'দোস্ত আমার খালা অসুস্থ, সবাই ব্যস্ত তাই আমাকেই যেতে হচ্ছে। ফিরতে দুদিন দেরী হবে। এদিকটা তুই একটু সামলে নিস।' আমি আচ্ছা ঠিক আছে বলে আবার কাজে লেগে পড়লাম।
সন্ধ্যার পরে শুয়ে আছি। শীতে হাত পা জড় হয়ে আসছিল। এমন সময় সুরভি এক কাপ গরম চা নিয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করলো। চা টেবিলে রেখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে কোনো কথা না বলে বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমি পিছন থেকে ডাক দিলাম,'সুরভি শোনো।' সে ঘুরে তাকিয়ে একটু ধীর গম্ভীর স্বরে বললো,'কিছু বলবেন?' আমি বললাম,' তোমার কি হয়েছে?' সে আগের ভঙ্গিতেই বলল,' কিছু না, কেনো?'
- এই যে এত চুপচাপ থাকো, কারো সাথে কথা বলো না। সব সময় অন্যমনস্ক হয়ে থাকো। তুমি ত এমন নও।
- আমি কেমন?
- তুমি সবসময় হাসিখুশি থাকা একজন মেয়ে। তাছাড়া অন্যদিন আমি আসলে তুমি এসে খোজ খবর নিতে অনেক গল্প বলতে। অথচ আজ চারদিন হলো এসেছি কিন্তু এখনো তুমি আমার সাথে কোনো কথা বলনি। কি হয়েছে তোমার?
'জানি না' একথা বলেই সুরভি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
৩.
অবশেষে আরও দু-দিন গত হয়ে আজ সেই শুভক্ষণ চলেই আসল। আজ সুরভির বিয়ে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। মেহমানদের মুখে কত শত গল্প। সেই গল্পের আওয়াজে মুখরিত পুরো বাড়ি। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে এইসব আনন্দময়ী দৃশ্যে মনোযোগ দিচ্ছি। পিছন থেকে লিলি এসে বললো, 'ভাইয়া আফা আফনারে পুকুর পাড়ে যাইতে কইলো।' বাড়ি থেকে অল্প দূরেই পুকুর। পুকুরের চারপাশে চেনা-অচেনা অনেক বৃক্ষ। একপাশে বৃক্ষ সারির মাঝখান দিয়ে পুকুরে নামার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সিঁড়িতেই বসে আছে সুরভি। আমি গিয়ে তার পাশে দাড়ালাম। সুরভি খুব মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছে পুকুরের জলে। আমায় দেখতে পেয়ে বললো, 'ভাইয়া এসেছেন, বসুন এখানে।' আমি তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, 'ডেকেছো কেনো?' সে বললো,'এমনি'।
- এমনি আবার কেউ কাউকে ডাকে নাকি?
- ডাকে।
- কে ডাকে।
- এই যে আমি ডাকলাম।
আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর সুরভি পুকুরের জলের দিকে তাকিয়েই বলল,' আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই একজনকে আমার ভীষণ ভালোলাগে। বড় হয়ে যখন ভালোবাসা শব্দটির সাথে পরিচিত হলাম। তখন আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করলাম আমার সেই ভালোলাগার মানুষটিকে আমি ঠিক কতখানি ভালোবাসি। কিন্তু কি জানেন ভাইয়া, আজ আমার বিয়ে অথচ এখনও তাকে আমার মনের কথাটি বলতে পারিনি। তাই আজ অন্তত একবার হলেও তাকে আমি বলতে চাই যে তাকে আমি ভালোবাসি।
আমি মনে মনে ভাবলাম সুরভি আজ কী সব আবল-তাবল বকছে, কিন্তু মুখে বললাম, 'কে সে?'
সুরভি অশ্রু মিশ্রিত মায়াভরা দু-চোখে আমার দিকে চেয়ে বললো,'আপনি।'