দরিদ্র বাবার বাস যাত্রা। A poor father bus journey


দরিদ্র বাবার বাস যাত্রা



সময়টা সকাল ১০ টা থেকে ১০:৩০ টা  হবে হয়তো। বেশ কয়েকদিন পর সেদিন কলেজ যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি লোকাল বাসে উঠে সোজা পিছনে গিয়ে জানালার পাশের একটি সিটে বসলাম। বাসে জানালার পাশে না বসলে আমার অস্বস্তি লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে। যাইহোক পাশের সিটে স্কুল পড়ুয়া এক অপরিচিত ছোট ভাই এসে বসলো।

কিছুদূর যেতে না যেতেই থেমে থেমে যাত্রী উঠানো লোকাল বাসের অন্যতম প্রধান কাজ।
বাসে উঠার একটু পরেই সামান্য দূরে গিয়ে আবার বাস থামলো। একজন মাঝ বয়সী লোক এবং একজন ৮-৯ বছর বয়সের ছেলে উঠলো। যাত্রীতে পূর্ণ ছিলো বাস। শুধু একজন যাত্রী বসার মত যায়গা ছিল। মাঝ বয়সী লোকটি সেখানে বসলো আর ছেলেটি দুপাশের সিটের মাঝখানে ফাঁকা যায়গাটায় বাম পাশের একটি সিট ধরে দারিয়ে রইলো।
মেঘমুক্ত নীল আকাশ। প্রখর রোদের তীব্র আলোয় শরীর থেকে ঘাম ঝড়ছিলো।
ক্রমে মাঝখানে ফাঁকা যায়গাটা চোখের পলকেই পূর্ণ হয়ে গেলো। তবুও কেন যেন আমার নজর ছিল মাঝ বয়সী লোক এবং ছেলেটির উপর। জানি না কেন?

সুপারভাইজার আসলো একে একে সবার কাছ থেকে ভাড়ার টাকা তুলতে তুলতে মাঝ বয়সী লোকটির কাছে গিয়ে ভাড়ার টাকা চাইলো। লোকটি দেখতে শ্যাম বর্ণের। আসলে শ্যাম বললে ভুল হবে লোকটি দেখতে কালো বর্ণের। পরনে পুরাতন একটা শার্ট ও লুঙ্গি। পায়ে পুরাতন এক জোড়া সেন্ডেল। ফিতাগুলো অনেক যায়গায় গুনা দিয়ে আটকানো। ঘামা শরীরে আধাছেরা শার্টটির পকেটে হাত ডুকিয়ে কিছু খুজরো কাঁচা টাকা বের করলো। শুধু খুজরো টাকা দেখে সুপাভাইজার কিছুটা রেগে গেলো। কিন্তু পরক্ষণে নিজের রাগ সংবরণ করে মাঝখানে দাড়িয়ে থাকা লোক গুলোর কাছ থেকে টাকা তুলা শুরু করলো।

গল্প এখানেই শেষ নয়......

দাড়িয়ে থাকা দুজন লোকের কাছ থেকে টাকা তুলার পর ছেলেটির কাছ থেকে টাকা চাইলো। ছেলেটি উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের। প্রায় ফর্সার কাছাকাছি। হাফ প্যান্ট, টি-শার্ট আর পায়ে মোটামুটি ভালো আছে এমন এক জোড়া সেন্ডেল। চুল গুলো তেল দিয়ে সুন্দর করে আচড়ানো। হয়তো তার মা আচড়ে দিয়েছে। দেখে যে কারো মায়া লাগবে তার প্রতি।

আসল কথায় আসি.....

এমন সময় পিছন থেকে কে যেন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো 'ভাই অয় আমার পুলা। এত ছোটো পুলা আরো দাড়ায় যাইতাছে অরে ছাইড়া দেন টাকা নিয়েন না।' পিছন ফিরে দেখি সেই মাঝ বয়সী লোকটি। কিছু বুঝে আসলো না এত ছোট ছেলেকে দাড় করিয়ে রেখে সে বসে যাচ্ছে।
এবার সুপারভাইজার পুরো রেগে গেলো এবং অকথ্য ভাষায় গালি গালাচ শুরু করলো। সাধারন সেই মাঝ বয়সী লোকটি নিরুপায় হয়ে চুপচাপ মুখ বুঝে সব সয়ে গেল।

এরপর যা হলো তা আমাকে সত্যিই আবেগি করে তুললো......

সুপারভাইজার গালি গালাচ করা শেষে বাকি যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তুলতে তুলতে সামনের দিকে অগ্রসর হলো।
মাঝ বয়সী লোকটি তার সিটটি ত্যাগ করে দাড়ালো। বুঝলাম না কেন? তারপর দেখি ছেলেটিকে হাত ধরে টেনে এনে সিটটিতে বসিয়ে দিয়ে মাঝ বয়সী লোকটি ছেলেটির স্থানে গিয়ে দাড়িয়ে রইলো। এবং পুরোটা পথ এভাবেই গেলো।

এতক্ষণে বুঝলাম আসল ফ্যাক্ট হচ্ছে টাকা। ছেলেকে আগে সিটে বসালে হয়তো দুজনেরই ভাড়া দিতে  হতো যা মাঝ বয়সী লোকটির পক্ষে হয়তো সম্ভব ছিলো না। তাই কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বুকের উপর পাথর রেখে আদরের সন্তানকে কিছু সময়ের জন্য দাড় করিয়ে রেখেছিলো। সেই অনুতাপে হয়তো এই বাবা মনে মনে পুরে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছিলো আর এই অভিশপ্ত দরিদ্রতাকে ঘৃণা ও দোষারোপ করছিলো।
তবে সন্তানের প্রতি বাবার অগাধ ভালোবাসা, এ ভালোবাসা মিছে নয়।

~ ওসমান আলী 

Post a Comment

0 Comments